মো মিজানুর রহমানচাঁ পাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
১৯৭১ সাল, চারিদিকে শুরু হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। সেসময় ২৩ বছর বয়সী অবিবাহিত যুবক তাজেমুল হক। প্রতিবেশী এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তাজেমুল। অংশ নেন গৌড় বাগানে (প্রশিক্ষণ ক্যাম্প) মৌলিক শারিরীক প্রশিক্ষণে। এরপর কাজ শুরু করেন গোয়েন্দা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের জানানোই কাজ ছিল তাজেমুলের।
মুক্তিযুদ্ধের এই গোয়েন্দার এখন দিন কাটে অর্ধাহারে-অনাহারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মেলেনি স্বীকৃতি। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মানুষের দ্বারে দ্বারে চেয়ে দিন পার করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ভগবানপুর মন্ডলপাড়া গ্রামের মৃত তৈমুর মন্ডলের ছেলে তাজেমুল হক (৭৩)। বাড়ি পাশে থাকা সজনে পাতা বিক্রি ও মানুষের কাছে দান হিসেবে যা পায় তা দিয়েই তাজেমুল ও তার স্ত্রীর দিন যায়। বসবাস করছেন মাটির পরিত্যক্ত ভাঙা একটি কুড়েঘরে।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দা এবং তাজেমুলের পরিবারের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও মেলেনি তার স্বীকৃতি। এমনকি স্বীকৃতি তো দূরের কথা এমন অসহায় অবস্থায় দিন পার করলেও তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নাই। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন স্বামী-স্ত্রী কোনভাবে অর্থানারে-অনাহারে দিন যায় তাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় দিবসের পর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় নিতে পারেননি সনদ। পরে কিছু কাগজপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হলেও তা হারিয়ে ফেলার কারনে এমন দুর্দশা হয়েছে তার, এমনটাই দাবি তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের।
তাজেমুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের শারিরীক প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া, গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার তথ্যগুলো নিশ্চিত করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কামান্ডার, একাধিক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ও উপজেলা ইউনিট কমান্ডার এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাথে একাধিকবার দেখা হয়েছে বলে জানান, তাজেমুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই ৭ নম্বর সেক্টের ৩ নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি “১৯৭১ আমার মুক্তিযুদ্ধ” শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। তিনি তার বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজেমুল হকের অবদান ও অংশগ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি তার বইতে লেখেন, “তাজেমুল হক নামের এক ছেলে ছিল, তাট বাড়ি মহারাজপুর চকআলমপুর। তাজেমুল আমাদেরকে গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতো। এমনকি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে যেত, খোঁজ-খবর নিতো।” বইতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজ করে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন, বর্তমানে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান জানান, তাজেমুল হক ও আমি একসাথে গৌড় বাগানে মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করি। পরে আমি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চলে গেলেও সে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেই থেকে যায়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কয়েক মাস পরেই দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই আমরা প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউমার্কেটে অস্থায়ী ক্যাম্পে অস্ত্র জমা ও সনদ গ্রহণ করি। তাজেমুলের সাথে থাকা অনেক মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে উপস্থিত থাকলেও তিনি ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত পরিচয় ও আত্নমর্যাদা পেয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের ক্ষমতায় আসার পর। এসময় থেকে তাজেমুলের জন্য একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় সুপারিশ করলেও তার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এখন খুবই অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছেন। শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগলেও অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা করেছেন, তা আমাদের কল্পনারও বেশি। তাই তাজেমুলের প্রতি নজর দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
তাজেমুল হকের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ইউনিট কামান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. গোলাম রাব্বানী, সাবেক জেলা কমান্ডার মো. সিরাজুল হক, সাবেক সদর উপজেলা কমান্ডার মো. আব্দুর রহমান। তারা সবাই তাজেমুলের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই-বাছাই করার সময় সুপারিশ করেছেন৷ এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে তাজেমুলের সহযোদ্ধা হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ নিশ্চিত করেছেন ও সুপারিশ করেছেন। তারা হলেন- জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মঈনুদ্দিন মন্ডল, শিবগঞ্জের হাজারবিঘী গ্রামের মানু মেম্বার, একই গ্রামের আব্দুল হান্নান কালু, সেলিনাবাদ এলাকার রবিউল ইসলাম, কালুপুরের মো. মন্টু, দক্ষিণ উজিরপুর গ্রামের একেএম হান্নান, একই গ্রামের নজরুল ইসলাম, হাজারবিঘী গ্রামের মো. মেশাররফ, মনাকষা হাউস নগর গ্রামের মো. কালাম মড়ল, মহারাজপুরের ভগবানপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুল ইসলাম, একই গ্রামের আব্দুল লতিফসহ অনেকেই।
স্থানীয় বাসিন্দা আমির ফয়সাল বলেন, আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সরকারের দেয়া সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমার বাবা মাঝেমধ্যেই তাজেমুলের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন জায়গায় অভিযানের কথা বলেন। কিন্তু তাজেমুলের কোন স্বীকৃতি মেলেনি। একমাত্র ছেলেও দীর্ঘদিন আগে বজ্রপাতে মারা গেছে। অনেক কষ্টে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন খুব অসহায় দিন যাচ্ছে তার। মারা যাবার আগেই তার নামটি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় থাকে।
তাজেমুলের প্রতিবেশী জালাল উদ্দীন জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ১০-১২ বছর। এসময় তাজেমুলকে আমি দেখেছি একটা ডিম কেনার ঝুড়ি